পায়ে হেঁটে লালাখাল

কুলাউড়ায় বড় আপুর বাসায় যাবো। সুরমা মেইল ট্রেনে যাবো ঠিক করলাম। কম খরচে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার মেইল ট্রেনে চড়ে মেইল ট্রেনের ভক্ত হয়ে গেছি। মেইল ট্রেনে নানা শ্রেনীর, নানা মানুষের গল্প খুব কাছ থেকে দেখা যায়। কম খরচে জীবনমুখী এমন দারুন স্কুলের ভক্ত না হয়ে উপায় আছে।

লালাখাল ভ্রমণের বিস্তারিত গাইড

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ তারিখ রাতে সময়মত কমলাপুর রেলস্টেশন চলে গেলাম। টিকেট ছাড়াই ট্রেনে চড়ে বসলাম। কুলাউড়ার ভাড়া ১০০ টাকা। ভেবেছিলাম ট্রেনে টিটি আসলে তাকে দিয়ে দিবো। কিন্তু পুরো জার্নিতে টিটির দেখা মিলে নাই। বিনা পয়সায় ট্রেন ভ্রমণের শাস্তি পাই ঢাকা ফেরত যাওয়ার পর। কি শাস্তি পাই তা গল্পের শেষে জানতে পারবেন।

মেইল ট্রেন চলছে। ট্রেন ভর্তি গল্প। আমি মন ভরে সেই গল্প দেখছি। রাতটা বেশ মজায় মজায় কেটে গেলো। দিনের শুরু হওয়ার পর বিরক্তি লাগা শুরু করলো। ট্রেন যতটা না চলে তারচেয়ে বেশি বসে থাকে। আমার গন্তব্যস্থল কুলাউড়া থেকে ১৪ কিলো আগে শমসেরনগরে ট্রেন ঝাড়া দুই ঘন্টা বসে থাকলো। ঘড়িতে সময় তখন দুপুর ১টা। আমার তখন মেজাজ তুঙ্গে। মনে মনে বার বার বলছিলাম আর যেই ট্রেনেই উঠি, জীবনে কোনদিন সুরমা মেইলে উঠছি না।

কুলাউড়ায় আপুর বাসায় কাজ শেষ করে এবার সিলেটের বাসে চড়ে বসলাম। মামার বাসায় যাওয়ার পর মামা অবাক। এতো রাতে আমি কোথা থেকে আসলাম। বললাম, সকালে লালাখাল ঘুরতে যাবো। তাই তোমার বাসায় রাতের বিরতি। আমার উড়ালচন্ডী স্বভাব সম্পর্কে জানা থাকায় কিছু বললো না।

আপুর বাসায় যাওয়ার সময়ই চিন্তা করছিলাম সিলেট শহরে তো অনেক ঘোরা হয়েছে, এবার কই যাওয়া? ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে লালাখালের স্বচ্ছ নীল রঙের পানি দেখে ঠিক করলাম লালাখাল যাবো। কিন্তু লালাখাল তো নৌকা ছাড়া ঘোরা যায় না। আমি একা মানুষ নৌকা রিজার্ভ করে ঘুরবো না। ফেসবুকে সার্চ দিয়ে পায়ে হেঁটে লালাখাল ঘুরার রুট প্ল্যান পেয়ে গেলাম। ব্যস, আর কি লাগে!

মামার বাসা থেকে সকালে বের হয়ে প্রথমে বন্দর বাজার গেলাম। বন্দর বাজার থেকে টিলাগড়। সেখান থেকে জাফলংগামী লেগুনায় চড়ে সারিঘাট বাজার। সারিঘাট বাজারে নেমেই সবুজাভ স্বচ্ছ পানির দেখা মিললো। যেই পানির জন্য লালাখাল ঘুরতে আসা। সারিঘাট বাজার থেকে লালাখাল জিরো পয়েন্ট যাওয়ার ট্রলার পাওয়া যায়। বাহারী রঙের ট্রলার দেখে চড়তে মন চাইলেও রিজার্ভ ভাড়া ৮০০ টাকা শুনে হাঁটা দিলাম।

ট্রলার ঘাট পার হয়ে একটু সামনে গেলে সারি নদীর সেতু। সেতুটা বেশ পছন্দ হলো। সেতু থেকে নদীর পানির নিচের কাঁদা মাটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, পানি এতটাই স্বচ্ছ। সেতু থেকে একটু সামনে নাজিমগড় রিসোর্টে যাওয়ার রাস্তা। রিসোর্টের রাস্তা পার হয়ে আরকেটু সামনে গেলে রাস্তা দুইভাগ হয়ে দুইপাশে চলে গেছে। ডানের রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলে লালাখাল অটোস্ট্যান্ড পড়বে। আমি ডানের রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। হুট করে রাস্তার মাঝখানে অদ্ভুত এক বাড়ি দেখলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম এটা বাড়ি না, মসজিদ। রাস্তার নিচে অর্ধেক ঢুকে আছে। মানে হচ্ছে মসজিদকে অক্ষত রেখে রাস্তা বানানো হয়েছে। আশেপাশে কেউ ছিলো না। নাহলে আরো বিস্তারিত জানা যেত হয়তো।

লালাখাল অটোস্ট্যান্ডে গিয়ে লোকাল অটোতে চড়ে বসলাম। ভাড়া ১৫ টাকা। লোকাল হওয়ায় বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হলো। আমার সময়ের তাড়া না থাকায় বসে থাকলাম। লালাখাল যাওয়ার পথে কয়েকটা গ্রাম পড়লো। ইচ্ছে করছিলো নেমে কিছুক্ষন ঘুরে দেখি। লোকাল অটো হওয়ায় তা সম্ভব হলো না। প্রায় ২০ মিনিটের সুন্দর অটো জার্নি শেষে লালাখাল চলে আসলাম।

লালাখালের পাড়ে দাঁড়িয়ে মন জুড়িয়ে গেলো। স্বচ্ছ নীলাভ জল দেখে মন জুড়াতে বাধ্য। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে চারপাশ দেখতে লাগলাম। চারিদিকে বেশ ব্যস্ততা। পর্যটক নিয়ে ট্রলার ঘুরে বেড়াচ্ছে, লোকাল নৌকায় করে স্থানীয়রা নদী পারাপার করছে, ছোট ছোট একদল শিশু পাথর কুড়াচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছিলো বাকিটা সময় এখানে বসেই কাটিয়ে দেই।

লালাখালের এখান থেকেও ট্রলার রিজার্ভ করে ঘুরে বেড়ানো যায়। এখানে রিজার্ভ ট্রলার ভাড়া ৩০০-৪০০ টাকা। আমি যেহেতু পায়ে হেঁটে ঘুরবো তাই নদী পার হওয়ার জন্য লোকাল নৌকায় উঠলাম। ৫ টাকায় নদী পার হয়ে লালাখাল চা বাগান চলে আসলাম।

লালাখাল চা বাগান ফ্যাক্টরি ঘাট থেকে আমার হাঁটা শুরু হলো। নিশ্চিন্তপুর স্কুল পার হয়ে লালাখাল চা বাগানে প্রবেশ করলাম। ফ্যাক্টরিতে তালা মারা থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। সিলেট, শ্রীমঙ্গলে অনেক চা বাগান দেখা হয়েছে। এছাড়া এবছরের ফেব্রুয়ারীতে পঞ্চগড় গিয়ে সমতলের চা বাগানও দেখে আসছি। চা বাগান তাই নতুন করে কোন উত্তেজনা সৃষ্টি করলো না। কিন্তু তখনও যে আরো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে তা কে জানতো।

চা বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুপারী বাগানের কাছে চলে আসলাম। দেখার মত আহামরি তেমন কিছু নেই। আরেকটু সামনে এগুতেই চক্ষু চড়কগাছ। চা বাগানের ঠিক পাশেই লালাখালের সবুজাভ নীল পানি দেখা যাচ্ছে। অনেক চা বাগান দেখলেও চা বাগানের পাশে এমন দৃশ্য তো আগে কখনো দেখি নাই। আমি ছিলাম চা বাগানের বেড়ার ভিতর। পানি দেখে বেড়ার নিচের ফাঁক গলে নদীর পাড়ে চলে আসি।

নদীর মাঝে ছোট ছোট ডিবি দেখে উঠা শুরু করি। ডিবির উপর থেকে চারপাশের দৃশ্য আরো মনোরম। বেশ অনেকটা সময় সেখানেই বসে থাকলাম। এমন সময় এক নৌকার মাঝি ভাই আমাকে ডিবির উপর একা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো আমি নৌকায় করে জিরো পয়েন্ট যাবো নাকি? জানালাম হেঁটে যাবো। বেশ অবাক হলেও আর কিছু বললো না।

লালাখালের পানি কতটা স্বচ্ছ তার একটা উদাহরন দেই। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পানির নিচের মাছ একদম স্পষ্ট দেখা যায়। মনে হয় চাইলেই হাত দিয়ে ধরা যাবে। খালি হাতে মাছ ধরার ব্যর্থ চেষ্টাও করি!

শীতের তাপহীন রোদে আবার চা বাগানের ভিতর ঢুকলাম। জিরো পয়েন্ট যাবো। শুরুতে যেই চা বাগান আহামরি কিছু লাগে নাই, তাই এখন বেশ ভালো লাগা শুরু করলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমি ছাড়া পুরো চা বাগানে কেউ নাই। একা একা ঘুরতে আরো বেশি ভালো লাগছিলো।

লালাখাল চা বাগান পার হয়ে আফিফা চা বাগান চলে আসলাম। এইখানে লালাখাল অনেক নিচুতে। টিলার আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হঠাৎ গাছগাছালির ফাঁক ফোঁকর নিয়ে নীল পানি দেখা যায়। তখন মন্ত্রমুগ্ধের মত কিছুক্ষন ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকি।

লালাখাল জিরো পয়েন্টের প্রায় কাছাকাছি চলে আসছি এমন সময় বিস্তীর্ণ সোনালী মাঠের সাথে দেখা। ধান কাটা শেষ। মাঠ জুড়ে গরুর পাল ঘাস খাচ্ছে। এমন কোন দৃশ্য দেখবো কল্পনাও করি নাই। আবারও প্রমান হলো কোন জায়গায় হেঁটে গেলে এমন সব দৃশ্যের সন্ধান পাওয়া যায় যা অন্য কোন উপায়ে সম্ভব না!

জিরো পয়েন্টে এসে বিপদে পড়লাম। এখানে নদী পার হয়ে অপর সাইডে যেতে হবে। স্থানীয়রা নদীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলেও আমার সাহসে কুলাচ্ছিলো না। সাঁতার পারি না। কোথায় পানি কতটুকু তাও জানি না। তাই বেশি সাহসিকতা দেখালাম না।

দূরে বালু দেখে ভাবলাম সামনে গিয়ে বালুর মাঠ পার হয়ে ঐপাড়ে যাবো। নদীর পাড় ধরে হাঁটছি হঠাৎ জোরে হাক শুনলাম। জিরো পয়েন্টে আছি দেখে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম কে ডাক দিচ্ছে। আমি দাঁড়ানোর পর ডাক থেমে গেলো। আমি আর সামনে না গিয়ে পিছনে এসে এক নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম আমি যেই পাশ ধরে হাঁটছি সেটা বাংলাদেশ কিন্তু যেই বালুর মাঠ পার হয়ে ঐপাড় যেতে চাচ্ছি তা ভারতে। আশেপাশে বিডিআর না থাকায় আমি এতদূর আসতে পারছি। বিডিআর থাকলে এই পাড় ধরে এতদূর আসতে দিতো না।

ঐপাড়ে যাওয়া হবে না বুঝতে পেরে এইপাড়ের নদীর পাড়ে বসে পড়লাম। মনমত সময় কাটিয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। যেই পথে এসেছি সেই পথেই হেঁটে যাবো। আসার সময় চারপাশ দেখতে দেখতে আসায় কতটা পথ হাঁটা লাগছে টের পাই নাই। কিন্তু এখন ফিরতি পথে বেশ টের পাচ্ছি, অনেক পথ হাঁটা হয়েছে।

লালাখাল অটোস্ট্যান্ডে এসে বিপদে পড়লাম। পর্যটকরা সবাই রিজার্ভ অটো নিয়ে আসছে। আর লোকাল অটো ছিলো না। বেশ অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। আগের মতই লালাখাল অটোস্ট্যান্ড নেমে হেঁটে সারিঘাট বাজার আসলাম। বাজার থেকে জাফলং থেকে আসা এক লেগুনায় চড়ে বসলাম। লেগুনা সরাসরি বন্দর বাজার নামিয়ে দিলো।

সারাদিনের অভুক্ত পেট তারপর হাঁটা হয়েছে অনেক। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছিলো। দেরি না করে জিন্দাবাজার পাঁচ ভাই হোটেলে চলে গেলাম। পেট চুক্তি ভাত, ভর্তা, মাংস খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা।

কদমতলী গিয়ে হানিফ বাসের টিকেট কাটলাম। বাসে উঠেই ঘুম। সারাদিনের হাঁটাহাটিতে বেশ ক্লান্ত ছিলাম। ভোর রাতে বাস ফকিরাপুল নামিয়ে দিলো। বাস থেকে নামার সময় মাথায় হাত। এক পায়ের স্যান্ডেল পাই না। পুরো বাস খুঁজেও কোথাও স্যান্ডেল পেলাম না। বাধ্য হয়ে খালি পায়ে নামলাম। তখনও মনে হলো সিলেট যাওয়ার দিন গাফিলতি করে ট্রেনের টিকেট কাটি নাই। তারই আক্কেল সালামী।

আমার লালাখাল ভ্রমণের রুটঃ

সিলেট শহর-> বন্দর বাজার -> সারিঘাট বাজার -> সারি সেতু পার হয়ে লালাখাল অটো স্ট্যান্ড-> লালাখাল-> লালাখাল চা বাগান-> লালাখাল জিরো পয়েন্ট

লালাখাল ভ্রমণের বিস্তারিত তথ্য জানতে লালাখাল ভ্রমণ গাইড পড়ুন।

ভ্রমণ শপথ

  • প্রকৃতিকে ভালোবাসবো, নোংরা করবো না।
  • স্থানীয় মানুষদের সম্মান করবো, বিবাদে যাবো না।
শেয়ার করে বন্ধুদের জানিয়ে দিন

Similar Posts